ঋষির পদাবলী (প্রথম পর্ব - আগমন)

১৯৮৮ সাল, চুয়াডাঙ্গা জেলার আলমডাঙ্গা থানার সীমানা ঘেষা জামজামি ইউনিয়নের ঘোষবিলা গ্রাম। চারপাশ এখনো পানির নীচে। মানুষ জনের মন থেকে এখনো বিভীষিকাময় বন্যার ভয় দূর হয় নাই। বানভাসি মানুষ কাঁদতে কাঁদতে চোখের নীচে চর ফেলে দিলেও বন্যার জল শুকায় না। প্রত্যেক বাড়ীর সাথেই একটা করে নৌকা বাধা। মানুষজন নৌকায় আর মালপত্র ঘরের চালে। গ্রামের একমাত্র বিদ্যাপীঠ এখন ভাসমান বাজারে পরিনত হইছে। পুরা বাজারটাই নৌকার উপরে। বিকাল বেলা নানান পসরায় ভরা নৌকায় ভরে থাকে বাজারটা। আর সন্ধ্যা হলেই শামসু নানার নৌকা ঘিরে কয়েকজন উৎসাহী মানুষের জটলা। সেটাও ঐ নৌকার উপরেই। ৭টা বাজলেই শামসু নানা তার জাপানী রেডিও খানা গলুই থেকে বের করে সংবাদ ছেড়ে দেয়। আর গ্রামের ময়-মুরব্বি তার লাল চাপান করতে করতে সারা দেশের দুরবস্থা নিয়ে আলোচনা করে এশার ওয়াক্তে যার যার বাড়ি ফিরে যায়।

১৪ই সেপ্টেম্বর, ১৯৮৮। সন্ধ্যার সময় গ্রামের প্রবীন ডাক্তার খন্দকার আবুল হক, প্রতিদিনের মত শামসুর ভাসমান চায়ের দোকানে নৌকা ভিড়ায়। চোখে মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ। ওদিকে আবার পশ্চিম আকাশে মেঘ করেছে। মেঘের দিকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে থাকতে দেখে শামসু জিজ্ঞেস করে, কি গো আবুল ডাক্তার। মেঘের দিকে চায়া কি দেহ? ডাক্তার সাহেব মুখ ঘুরিয়ে চায়ের কথা বলে নৌকার পাটাতনে বসে বাড়ীর কথা বলে।

শামসু নানা শুনে বলে, হ তোমার বড়মাইয়ার তো বাচ্চা হইব। তয় ছাওয়াল না মাইয়া? বড়ডা তো মাইয়া তাইনা?

ডাক্তার মাথা ঝাকিয়ে সায় দেয়। মাইয়ার আগে তো একখান পোলা হইয়া মারা গেল। এইবার কি হইব আল্লাই জানে। বলতে বলতে বাড়িয়ে দেয়া চায়ের ভাড় নিয়ে বসতেই দেখে বাঁক ঘুরে একটা নৌকা এদিকেই আসছে। নৌকাটা আরেকটু কাছে এলেই নৌকার উপরে তার ছোট অর্থাৎসপ্তম ছেলে রাসেলকে দেখে চোখ কুঁচকে যায়। অজানা দুশ্চিন্তায় মনটা ভরে ওঠে।

নৌকাটা তার নৌকার সাথে ঠেকতে রাসেল লাফ দিয়ে নামতেই নৌকাটা দুলে ওঠে। ভাড় থেকে একটু চা চলকে পাঞ্জাবীতে পড়তেই ডাক্তার ছেলের দিকে কটমট করে তাকায়। রাসেল তখন হাপাতে হাপাতে বলে, আব্বা বুজি ব্যাথায় চিল্লাইতেছে। মায় তোমারে তাড়াতাড়ি নাও নিয়া বাড়িত যাইতে কইছে। ডাক্তার শুনেই চায়ের কাপ ফেলে বৈঠা ঠেলে নৌকা ঘুরায়। যেতেযেতে বলে চার দাম কাইল দিবানেরে শামসু। মাইয়াডার লাইগ্যা দোয়া করিস। বলেই ছেলেকে নিয়ে বাড়ীর দিকে রওনা হয়।

বাড়ীর কাছাকাছি আসতেই বাড়ির ভেতর থেকে কান্নার আওয়াজ শুনে ডাক্তারের বুকটা কেপে ওঠে। সুরা ইয়াছিন পড়তে পড়তে নৌকাটা বাড়ীর ভেতর ঢুকাতেই দেখেন আশেপাশের দুই-দশ বাড়ির মানুষ সবাই ভেতরে জটলা করে আছে। তিনি গলা খাকারি দিতেই সবাই জায়গা করে দেয়। তার স্ত্রী তাকে দেখে কান্না মেশানো গলায় চিতকার করে ওঠে। তিনি মনে মনে ঘাবড়ে গেলেও কাউকে বুঝতে দেন না। তিনি নিজে একজন রাজশাহী মেডিকেল কলেজের প্রথম ব্যাচে পাশ করা ডাক্তার। দীর্ঘ ডাক্তারী জীবনে ডেলিভারির কেস তেমন কিছুই না তার কাছে। কিন্তু তার দুশ্চিন্তা একটাই তার মেয়ে অত্যান্ত রোগা। কিছুদিন যাবত আবার রক্ত শূন্যতায় ভুগছে। কিছুক্ষন ইতস্তত করে তিনি মেয়ের ঘরে প্রবেশ করেন।

ঘরের ভেতরে দুইটা খাট একটার উপরে আরেকটা রাখা। তার উপরে প্রায় হাড্ডিসার কন্যাকে অচেতন অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে বিচলিত হয়ে বাইরে বেড়িয়ে আসেন। এসেই জিজ্ঞেস করেন রাবেয়াকে খবর দেয়া হইছে কিনা? রাবেয়া এই অঞ্চলের একমাত্র পাশ করা গাইনি ডাক্তার। বয়স বেশি না হলেও এই কয়েকদিনেই বন্যা দুর্গত মানুষের মন জয় করে নিয়েছে তার হাসি-খুশি স্বভাবের কারনে। তার সেজ ছেলে টুকু রাবেয়াকে আনতে গেছে শুনে তিনি কিছুটা আস্বস্তবোধ করে আবার ঘরে ঢুকে পরেন। ঢুকেই তিনি স্ত্রীকে হুকুম দেন দুইজন বাদে সবাইকে বাইরে যেতে বলার জন্য। সবাই চলে গেলে তিনি তার স্ত্রীকে গামলায় ভরে পানি আনতে বলে নিজে মেয়ের পাশে বসে মাথার নিচে বালিশ ঠিক করে দেন। তারপর নাড়ী দেখে নিশ্চিন্ত হন বেচে আছে।

বাইরে কোলাহল শুনে বের হয়ে দেখেন রাবেয়া এসেছে। ওকে নিয়ে ঘরে ঢুকতেই রাবেয়া বলে, এখানে ডেলিভারী করা সম্ভব না, জায়গা কম। তিনি ইকুকে হুকুম দেন আরো দুইটা খাট নিয়ে আসার জন্য। খাট নিয়ে আসার মাঝপথেই দুইবার মেঘ জানান দিয়েই বৃষ্টি ঝরানো শুরু করে। বৃষ্টিকে দুইচার গালমন্দ করে তিনি ছেলেদেরকে তাগাদা দেন। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতেই তার ছেলেরা দুইখান খাট যোগাড় করে নিয়ে আসে। ওদিকে রাবেয়া প্রস্তুত হতে থাকে, মাঝে মাঝে মেয়ের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকায়। আর চিন্তা করে এই মেয়ের ডেলিভারী সে কি করে করবে। শরীরে তো একফোটা রক্ত আছে বলে মনে হয় না। ডাক্তারের কথাশুনে ফিরে তাকাতেই মেয়ের মা আর একজনকে থাকতে বলে সবাইকে বের করে দিয়ে দরজা লাগিয়ে দেয়।

ঘুরে দাঁড়িয়ে মেয়ের সারা শরীরে চোখ বুলিয়ে পেটের দিকে তাকাতেই আরেকবার চমকে ওঠে। আবছা অন্ধকার ফুলে ওঠা পেট দেখে ভাবে বেশ স্বাস্থ্যবান ছেলেই আছে ভেতরে। বাইরে দুইবার বাজ পরার শব্দ হতেই কেপে উঠে কাজে হাত লাগায়। ঘন্টা ২-৩ চেষ্টা করে চিন্তিত মুখে মেয়ের মায়ের দিকে তাকায়। দু জনেই ঘেমে একেবারে ভিজে গেছে। বাইরে অনবরতঝড় বেড়েই চলেছে। বাতাসের দমকায় জানাল খুলে পানির ছাট ঘরে ঢুকে পরে। রাবেয়া আরো কিছুক্ষন চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিয়ে আচলে হাত মুছতে মুছতে থাকে। এদিকে মেয়ের পানি ভেঙ্গে বিছানা ভিজে গেছে। হারিকেনের ঝাপসা আলোয় রক্ত দেখে মেয়ের মা ডুকরে কেদে ওঠেন। রাবেয়া ঘাবড়ে গিয়ে ডাক্তার সাহেবকে ডাকেন। বাচ্চা কিছুতেই নিচে নামছে না। রাবেয়ার কথা শুনে ডাক্তার সাহেবের কপালে ভাজ পড়ে। মেয়ের মা ডাকতেই রাবেয়া ভেতরে চলে যায়। 

ডাক্তার সাহেব বিচলিত মন নিয়ে নৌকার উপরে পায়চারি করতে থাকেন। চারপাশে বাজ পড়ারশব্দ আর বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ নেই। তিনি আরো কিছুক্ষন পায়চারী করে গোয়ালঘরের দিকে নৌকা ঘোরাতে দেখে, তার বড় ছেলে একটা হারিকেন নিয়ে নিঃশব্দে তাকে অনুসরন করে। গোয়ালঘরের মাচাঙ্গে রাখা ডাক্তার সাহেবের টিনের ট্রাঙ্ক খুলে মখমল কাপড়ে মোড়া একখানা চৌকা বাক্স হাতে নিয়ে কিছুক্ষন কোমর পানিতে দাঁড়িয়ে থাকেন। তারপর মাথা ঝাকিয়ে পানি ডিঙ্গিয়ে বেরিয়ে আসেন। নৌকায় ঊঠে আতুড় ঘরের দিকে যেতেই রাবেয়াকে ডাক দেন। রাবেয়া দরজা খুলে বের হতেই তিনি বাক্সটা ওর হাতে দিয়ে বলেন যা ভাল মনে হয় করতে। রাবেয়া অবাক হলেও বাক্স খুলে দেখে সিজারের প্রায় প্রয়োজনীয় সব যন্ত্রপাতি আছে। হঠাত মনে পড়ে যায় উনি নিজেও একজন ডাক্তার।

রাবেয়া চলে যেতেই তার মনে হয় মেয়ে জামাইকে কি খবরটা দেয়া হয়েছে। জামাই তখন পোড়াদহ রেল স্টেশনের টি.সি হয়ে ওখানেই আছে। কিন্তু ঝড়ের জন্য খবর দেওয়া হয় নাই। তিনি মনে মনে দোয়া দরুদ পড়তে পড়তে ঝড়ের দিকে তাকিয়ে পায়চারী করতে থাকেন। অন্যান্য সবাই যার যার আসনে বাচ্চার কান্না শোনার জন্য উদগ্রীব হয়ে বসে আছে। যদিওআগের থেকে মানুষজন অনেক কমে গেছে। তারপরও যা আছে সেটাও খারাপ না। সবাই তটস্থ হয়ে আছে, কখন কি হয়।

ভেতরে রাবেয়া মাকে বলে অপারেশনের যন্ত্রপাতি গুলো গরম পানিতে পরিষ্কার করতে। নিজেও পরিষ্কার একটা শাড়ী এপ্রোনের মত করে জড়িয়ে মেয়ের পেটে একটু একটু করে চাপ দিয়ে বোঝার চেষ্টা করে বাচ্চার অবস্থান।। আরো ঘণ্টাখানেক চেষ্টা করে কোনমতেই কায়দা না করতে পেরে, আল্লাহ এর নাম নিয়ে অপারেশন করতে প্রস্তুত হয়।

দীর্ঘ ৩ ঘটা ধরে চেষ্টার পর ১৫ই সেপ্টেম্বর প্রথম প্রহরে মায়ের পেটের ভেতর থেকে একটা রক্তে মাখা বাচ্চার শরীর পা ধরে বের করে পাশে কাপড়ের উপরে রাখে। নাড়ী কেটে গিঁট দিয়ে চিন্তিত মুখে একবার বাচ্চার দিকে আরেকবার বাচ্চার নানির মুখের দিকে তাকায়। এতকিছু ঘটে গেলেও বাচ্চার মার একবারের জন্যও জ্ঞান না ফেরার টেনশনে রাবেয়াও একটু ঘাবড়ে যায়। বাচ্চাকে নানির কাছে দিয়ে পরিষ্কার করতে বলে, নিজে বাচ্চার মায়ের ক্ষতস্থান পরিষ্কার করে সেলাই করতে থাকে। সেলাই করা শেষ হলে, বাচ্চাকে ধরে পাছায় জোরে দুইটা চড় মারায় বাচ্চা সশব্দে কেদে উঠে তার আগমনের বার্তা জানায়। ঝড়ের প্রকোপ আস্তে আস্তে কমতে থাকায় বাইরে অপেক্ষমান সবাই কান্নার আওয়াজ শুনে খুশী হয়। ডাক্তার সাহেব আল্লাহ্‌ এর কাছে শূকরিয়া জানিয়ে মোনাজাত করে আঁতুড় ঘরের দিকে এগোতে থাকে। দরজা খুলে বাচ্চার নানী পানি পেরিয়েই বাচ্চাকে নানার কোলে তুলে দিয়ে বলে, ব্যাডা হইছে। ডাক্তার সাহেবকে ঘিরে থাকা সবাই খুশীতে চিতকার করে ওঠে। সারারাত ধরে ঝড়-বৃষ্টিতে ভিজে অপেক্ষা করা সবার কষ্ট এক নিমিষেই আনন্দে পরিনত হয়। ডাক্তার সাহেব খুশী হলেও একবার চিন্তিত হয়ে ঘরের ভেতর উকি মারতে দেখে তার স্ত্রী বলে, মেয়েও ভালআছে। তিনি নিশ্চিন্ত হয়ে বড় ছেলেকে বলেন আজান দিতে। ছেলের বড় মামা, এই দুর্যোগেরমাঝেই ঘরের চালে উঠে গলা ছেড়ে আজান দিয়ে জানান দেয় খন্দকার বাড়ির বড় নাতির আগমন।

ডাক্তার সাহেব বাচ্চাকে তার নানির হাতে তুলে দিয়ে রাবেয়ার দুহাত জড়িয়ে শুকরিয়া আদায় করতে করতে কেঁদে ফেলেন। কিছুক্ষন পর তিনি শান্ত হয়ে পাঞ্জাবির পকেটেরাখা তার অনেকদিনের শখের সোনার পকেট ঘড়িটা রাবেয়ার হাতে তুলে দিয়ে বলেন, আমার বংশের প্রথম নাতি তোমার হাতেই হইল। এই সামান্য উপহার তোমারে রাখতেই হবে। রাবেয়া বিব্রত হলেও বৃদ্ধ মানুষের খুশীর জন্য উপহারটা গ্রহন করে তার গন্তব্যের দিকেযাত্রা করে।

ডাক্তার সাহেব নাতির মুখের দিকে তাকিয়ে নাম রাখেন "মোহাম্মদ তৌহিদুল আলম খান"। তিনি তার ছেলেদের হুকুম দেন, সকাল হলেই ময়রা বাড়ী গিয়ে মিষ্টির ফরমাশ দিতে। গ্রামের কেউ যেন এই খুশী থেকে বাদ না যায়। আর অবশ্যই সকাল বেলাই যেন ছেলের বাপকেখবর দেওয়া হয়। বলে তিনি নৌকা নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে যান। এই ভোর রাতে তার যাত্রাপথে তাকিয়ে তার স্ত্রী চিন্তিত হলেও বাধা দেননা।

এর প্রায় ৪ দিন পর প্রথম ছেলেটি তার মায়ের বুকের দুধ খেতে পারে, মায়ের কোলেউঠতে পারে। তারও প্রায় ৩ দিন পর ছেলে বাবা হাজির হয়। বড়ছেলেকে দেখতে না পারার কষ্টে তিনি এবার আগভাগেই এসে পড়েন। এসেই তার বংশের প্রথম ছেলেকে দেখে কেঁদে ফেলেন, একই সাথে তার মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসা স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে ভালবাসা ভরা হাসি দিয়ে ধন্যবাদ জানান। তার স্ত্রীও মাথা ঝাকিয়ে চোখের ইশারাতেই ধন্যবাদ টুকু ভালবাসার সাথেই গ্রহন করে চোখ বুজে শুয়ে থাকে।

কারও মনেই থাকে কি ভয়ানক দুর্যোগ মাথায় নিয়ে ছেলেটি পৃথিবীতে আসে। কেউ ভাবতেই পারে না, এই ছেলে ভবিষ্যতেও কি পরিমান দুর্যোগের জন্ম দেবে। সে গল্প না হয় আরেকদিন বলা যাবে।

-------
আমি বহুদিন একা একা প্রশ্ন করে দেখেছি নিজেকে,
যারা খুব হৃদয়ের কাছাকাছি থাকে, যারা এঘরে ওঘরে যায়
সময়ের সাহসী সন্তান যারা সভ্যতার সুন্দর প্রহরী
তারা কেউ কেউ বলেছে আমাকে
এটা তোর জন্মদাতা জনকের জীবনের রুগ্নরূপান্তর
একটি নামের মধ্যে নিজেরি বিস্তার ধরে রাখা,
তুই যার অনিচ্ছুক দাস!

---
ঋষি নিবাস,
রামপুরা, ঢাকা
৬ আশ্বিন ১৪২৫

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

যমুনার মাঠ