যমুনার মাঠ

১.
ভাদ্র মাসের মাঝামাঝি। আকাশটা নীল রঙের সমুদ্র মাথার উপরে ছেয়ে আছে, আর মাঝে মাঝে সাদা তুলোর মত সেই নীল সমুদ্র বেয়ে ভেসে যাচ্ছে। দৃশ্যটা সুন্দর, শরত সবসময় মানুষের মনকে একটু উদাসীন করে তোলে। কিন্তু এখানে, এই পরিবেশে সেই উদাসীনতা উবে যায় বাষ্পের মত। যতদুর চোখু যায় শুধু মাটি, পুড়ে বাদামী হয়ে যাওয়া মাটিগুলো ফেটে চৌচির হয়ে শুধু ছড়িয়ে আছে। গাছ তো দুরের কথা, কোথাও কোন ছোটখাটো ঝোপও নেই। আশে পাশে যত লোকালয় সবই দিগন্তে ছবি হয়ে ঝুলে আছে। উপর থেকে দেখলে মনে হবে নাপিত বিশাল ক্ষুর দিয়ে পৃথিবীটাকে ন্যাড়া করতে গিয়ে হঠাত উঠে গিয়েছে, এক্ষুনি এসে বাকিটুকু শেষ করবে। কিন্তু এর মাঝেও একটা বটগাছকে দেখা যায় মাথা উচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। গাছটার বয়স আশপাশের গ্রামের মত অনুযায়ী চারশ বছর। সেই তুলনায় এর ব্যাপ্তি বেশী না। কিন্তু এই কঠিন পরিবেশে বেচে আছে কি করে সেটা অবাক করার বিষয় বটে। ঈশ্বর বোধহয় দয়া করে গাছটি লাগিয়েছিলেন। এবং পরিচর্যাও স্বয়ং ঈস্বরই নেন সেটাও এখানকার মুরব্বীদের ধারনা। সেটা কতটুকু সত্যি তা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। এই রুক্ষ কাঠা ফাটা রোদ্দুরেও অল্প কয়েকটা পাতা নিয়ে দাঁড়িয়ে এতগুলো বছর বেচে থাকা সহজ কথা নয়। যে পরিবেশে একটা শকুনও বাচতে পারে না, সেখানে এই গাছটা বেচে আছে। আর একারনেই এত বছর ধরেও সে নিজেকে বিসৃত করতে পারেনি, কারন তার বেচে থাকতেই শক্তিটুকু শেষ হয়ে যায়। এই গাছটার স্থানীয় একটা নাম আছে, “উষর বেনে” অর্থ “বন্ধ্যা বটগাছ”। 


২.
পানির বোতলটা মুখে নিয়ে অনেক্ষন ঝাকা ঝাকি করেও একফোঁটা জল পায় না। এদিকে দুদিন ধরে অভুক্ত শরীর তারওপরে গলাটা তেষ্টায় শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে। বোতলটা ছুড়ে ফেলে দিয়ে ব্যাগ হাতড়াতে থাকে। পাগলের মত খুজতে থাকে, যেন একটা পানির ঝরনা ব্যাগের কোথাও লুকিয়ে আছে। না পেয়ে সেটাও ছুড়ে দেয়। মাথার চুল টেনে হাটু গেড়ে বসে পরে, চিতকার করতে থাকে, কিন্তু সে চিতকার বাতাসে কোন কম্পন তোলে না। তবুও কষ্টে কাদতে থাকে। আচ্ছা এটাকে কি কান্না বলে? কান্না বলতে তো চোখের জলকে বোঝায়, কিন্তু এই পানিশুন্য শরীয়ে চোখে জল আসবে কোথা থেকে। মাটিতে শুয়ে পরে চুল হাচরাতে থাকে। আর কিছুক্ষন পর পর ফেটে যাওয়া ঠোটদুট জিব দিয়ে চাটতে থাকে। সেটাও অভ্যাসে বসে, কারন শুনো ঠোঁটের উপরে ধুলোর আস্তরন পড়ে আছে, আর সে সেই ধুলোই জিব দিয়ে চেটে নিচ্ছে। কিছুক্ষন পাগলের মত গাড়াগড়ি পেরে শুয়ে থাকে। গায়ের ময়লা জামা ধুলোয় সাদা, মাথার জট পাকানো চুলও সাদা। কিন্তু তার কোন দিকেই খেয়াল নেই। চোখ বুঝে শুয়ে থাকে। শুধুমাত্র বুকের ওঠা-নামা দেখেই বোঝা যায় প্রান এখনো আছে।


কতক্ষন শুয়ে আছে জানে না। হঠাত চোখ খুলতে দেখে দিগন্তে একটা গাছ নেচে বেড়াচ্ছে। কিছুক্ষন চেয়ে থেকে বুঝতে চেষ্টা করে স্বপ্ন নাকি সত্যি। কিন্তু বুঝতে না পেরে চোখটা বন্ধ করে ফেলে। কিছুক্ষন পরে আবার চোখটা খুলে দেখে গাছটা আগের যায়গাতেই আছে। উঠে বসে, ময়লা হাত দিয়ে চোখটা কচলে নেয়। তবুও গাছটা যায় না। মরীচিকার মত প্রলোভন দেখিয়ে নাচতেই থাকে। উঠে দাড়াতে গিয়ে পরে যায়, শরীরে শক্তি নেই। পড়ে, শুয়েই থাকে। বড় বড় শ্বাস নেয়। জলের তেষ্টাটা আবার জানান দিচ্ছে। চোখটা খুলে আরেকবার দেখে নেয় গাছটাকে। আবার উঠে বসে, চারদিকে চোখ বুলায়। কিন্তু দিগন্তে কিছু দেখতে না পেয়ে আবার মুখ ঘুরিয়ে গাছটা দেখে নেয়। কিছুক্ষন গড়িয়ে গড়িয়ে ব্যাগটার কাছে যায়। হামাগুড়ি দিয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাক ব্যাগের জিনিষগুলো কুড়িয়ে নেয়। তারপর অনেক কষ্টে উঠে দাঁড়ায়। পা দুটো কেঁপে ওঠে, কিন্তু এবার আর পড়ে না। এলোমেলো পা ফেলে আস্তে আস্তে এগোতে থাকে। কিন্তু কিছুদুর গিয়েই পড়ে যায়। শরীরে কোন শক্তিই অবশিষ্ট নেই। পড়ে শুয়েই থাকে। বড় বড় শ্বাস নিয়ে প্রান পাখিটাকে বাচিয়ে রাখার আপ্রান চেষ্টা করে। কিছুক্ষন শুয়ে থেকে আবার ঘুরে দেখে গাছটা আছে কিনা। আচে... গাছটা আগের জায়গাতেই আছে। হামাগুড়ি দিয়েই এগোতে থাকে।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ঋষির পদাবলী (প্রথম পর্ব - আগমন)